পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জনের ঘটনা বিরল। সেই ব্যতিক্রমী ইতিহাসের অংশীদার বাঙালিরাই, যারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে প্রাণ দিয়েছিলেন। রফিক, শফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ নাম না জানা অনেক শহীদের আত্মত্যাগের ফলেই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই আন্দোলনই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গত ৫৩ বছরে অসংখ্য সিনেমা নির্মিত হয়েছে, যা নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে সাহায্য করছে। এটি অবশ্যই আশার কথা। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, যে আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের বীজ বুনেছিল, সেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে সিনেমার সংখ্যা হাতেগোনা!
গত ৭৩ বছরে ভাষা আন্দোলন নিয়ে মাত্র তিনটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। প্রথমটি ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া জহির রায়হানের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। চলচ্চিত্রটি রাজনৈতিক প্রতীকী উপস্থাপনার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ফুটিয়ে তুলেছিল। এতে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, সুচন্দা, আনোয়ার হোসেন, রওশন জামিলসহ অনেকে।
দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৬ সালে নির্মিত হয় ভাষা আন্দোলনভিত্তিক দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘বাঙলা’, পরিচালনা করেন শহীদুল ইসলাম খোকন। এতে প্রধান চরিত্রে ছিলেন মাহফুজ আহমেদ, শাবনূর ও হুমায়ূন ফরীদি।
সবশেষ ২০১৯ সালে মুক্তি পায় তৌকীর আহমেদের ‘ফাগুন হাওয়ায়’, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলীকে সরাসরি চিত্রায়িত করেছে। এতে অভিনয় করেন সিয়াম আহমেদ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, ফজলুর রহমান বাবু, আবুল হায়াতসহ অনেকে।
এই তিনটি সিনেমাই দর্শকের আগ্রহ কুড়িয়েছে, যা প্রমাণ করে ভাষা আন্দোলনভিত্তিক কন্টেন্টের চাহিদা রয়েছে। বিশ্বজুড়ে ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রবণতা বেড়েছে, ভারতের মতো দেশও জাতীয় ঘটনাগুলোকে বড় পর্দায় তুলে ধরছে এবং ভালো ব্যবসা করছে। অথচ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়েও এ বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বছরে গুটিকয়েক নাটক প্রচার হলেও বাঙালির সংস্কৃতির অংশ নয় এমন দিবস, যেমন ভালোবাসা দিবস ঘিরে অসংখ্য নাটক প্রচারিত হয়।
জাতীয় দিবসের প্রতি এই উদাসীনতা নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে—এমনটাই মনে করেন ইতিহাসবিদরা। তাই এখনই সময় ভাষা আন্দোলন নিয়ে আরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণের, যাতে নতুন প্রজন্মের কাছে এই গৌরবময় ইতিহাস সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়।