সম্প্রতি লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে। বৈঠকের পরপরই বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো বেশ উচ্ছ্বসিত। এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য আগামী জাতীয় নির্বাচন। একইসঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
বৈঠকের পর বিএনপির অবস্থান অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। এতদিন অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি দলটির নেতারা ছিলেন সমালোচনামুখর। কিন্তু এখন তার সঙ্গে নির্বাচনী সময় নির্ধারণ ও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে আলোচনার পর বিএনপি নেতৃত্ব তার ভূমিকা নিয়ে আশ্বস্ত। বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে ঐকমত্য হয় এবং রমজান শুরুর আগেই নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব উঠে আসে।
তবে এই বৈঠনে মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা কিংবা তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ— এসব ইস্যু আলোচনায় আসেনি বলে বিএনপি নেতারা দাবি করছেন। এমনকি যাদের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছিল, তাঁদের একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এবং তারেক রহমানকে স্বাগত জানান। বিএনপির পক্ষ থেকে এটিকে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, বৈঠকে কেবল নির্বাচনের সময় নয়, বরং ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনৈতিক কৌশল, ও জাতি গঠনের নানা বিষয়েও আলোচনা হয়। তারেক রহমান অধ্যাপক ইউনূসের অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকে ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে চান। যদিও ইউনূস পরে চ্যাথাম হাউস আয়োজিত এক আলোচনায় স্পষ্টভাবে বলেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করবেন না এবং নির্বাচনে বিলম্ব ঘটানোর পক্ষে নন।
লন্ডন বৈঠকের পর বিএনপি নেতৃত্ব বলছে, অতীত ভুলভ্রান্তি ভুলে গিয়ে এখন জাতীয় ঐক্যের দিকে এগোনোর সময়। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতে, “জাতির ক্রান্তিলগ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর একসঙ্গে কাজ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। সব দল ভুল করতে পারে, কিন্তু তা নিয়ে পড়ে থাকলে সামনে এগোনো যাবে না।”
এদিকে, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল বৈঠকের পর নিজেদের অবমূল্যায়িত মনে করছে। তাদের মতে, সরকার ও বিএনপির যৌথ বিবৃতি একটি বার্তা দিয়েছে যে বিএনপিই প্রধান বিরোধী শক্তি, অন্য দলগুলো অনুল্লেখযোগ্য। এনসিপি থেকে শুরু করে জামায়াত পর্যন্ত অনেকে আশঙ্কা করছে, এই মনোভাব নির্বাচনী মাঠে তাদের জন্য প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
জামায়াত এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার পক্ষপাতমূলক আচরণে ভবিষ্যৎ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তারা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে বিষয়টি তুলতে চায়।
বিএনপি অবশ্য এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। আমীর খসরু বলেন, “বিএনপি সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। এখানে অন্যদের অবজ্ঞা করার প্রশ্নই আসে না। সবাই নির্বাচনের সময় নিয়ে একমত। এমনকি জামায়াতও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের পক্ষে।”
অন্যদিকে বিএনপির সমমনা দলগুলো লন্ডন বৈঠককে ইতিবাচকভাবে দেখছে। তারা জানিয়েছে, এই আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের পথে থাকা পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হলেও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’, ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন এবং সেই সময়ের গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের বিচারের দাবি নিয়ে ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হতে পারে। বিএনপি বলছে, এসব বিষয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অগ্রসর হবে এবং চলমান বিচারিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
সব মিলিয়ে, লন্ডন বৈঠকের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে ফিরে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন দলটির মূল ফোকাস নির্বাচনের প্রস্তুতি ও তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় নির্ধারণ। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো এই সমঝোতার বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন।